আওরঙ্গজেব কামালঃ
জুলাই মাসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক,সামাজিক ও পেশাগত অঙ্গনে যে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে, সাংবাদিকতা পেশা
তার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। স্বাধীনতা, জবাবদিহিতা এবং জনকল্যাণের
বার্তাবাহী একটি পেশা আজ গভীর হতাশা, নৈতিক অবক্ষয় এবং বিভক্তির
মুখে।সাংবাদিকতা শুধুই খবর প্রকাশ নয়, এটি একটি দায়বদ্ধতা—সত্য,
ন্যায্যতা ও জনস্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি। জাতির দর্পণ হিসেবে কাজ করে
এমন একটি পেশা বর্তমানে চরম প্রশ্নবিদ্ধ। এর পেছনে যেমন রাজনৈতিক
চাটুকারিতা ও দলবাজির ভূমিকা আছে, তেমনি ভুয়া সাংবাদিকদের উদ্ভট
কর্মকাণ্ডও এই পেশাকে করেছে কলুষিত ও জনবিচ্ছিন্ন। বর্তমানে মাঠে
মূলধারার সংকট, ভুয়া সাংবাদিকের দাপটে প্রকৃত সাংবাদিকরা এ পেশা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। গ্রামের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত ‘সাংবাদিক’ নামধারী এক শ্রেণির মানুষ মিডিয়া কার্ড ঝুলিয়ে চাঁদাবাজি, জমি দখল, নারী কেলেঙ্কারি, এমনকি ব্ল্যাকমেইলিং-এ জড়িয়ে পড়েছে। এরা হয়তো নিজের নাম পর্যন্ত ঠিকমতো লিখতে জানে না, তবু ‘সিনিয়র সাংবাদিক’ বা সম্পাদক’ হিসেবে পরিচয় দেয়। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন ভুয়া সাংবাদিকদের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এরা ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে সাংবাদিকসহ সকল শ্রেনীর মানুষ কে হয়রানী করছে। সাধারণ মানুষ এবং প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকদের জীবনে আজ এদের কারণে নিরাপত্তা হুমকির মুখে।
প্রশাসনের একটি অংশ এবং কিছু রাজনৈতিক শক্তির প্রশ্রয়ে এদের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে। অনেক সময় দেখা গেছে, পুলিশের সোর্স হয়েই কেউ রাতারাতি সাংবাদিক বনে গেছে। সাংবাদিকতার এই বিকৃত চেহারা সাংবাদিকতার মূল আদর্শের
সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। দলবাজি ও চাটুকারিতায় গুণগত পতন এখন এইসব ভুয়া সাংবাদিকদের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। গত ১৫ বছরে সাংবাদিকতা পেশায় ঢুকে পড়েছে চরম দলবাজি ও চাটুকারিতা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র হয়ে ওঠা কতিপয় সাংবাদিক বিভিন্ন দপ্তর থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে পেশাগত নীতিমালাকে বিসর্জন দিয়েছে। এর ফলে সাংবাদিক সমাজ দ্বিধা-বিভক্ত
হয়ে পড়েছিল। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানর পর সাংবাদিকদের যে প্রত্যাশা ছিলো তা পূরণ হয়েছে? আমার মনে হয় হয়নি। বর্তমানে এক অজানা ভয় পেয়ে বসেছে গণমাধ্যমকর্মীদের মনে ৷ অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন বা আগে হারিয়েছেন ৷ কারণ দৃশ্যমান নয় ৷ দেশে সাংবাদিকদের নিয়ে মব সন্ত্রাসের ভয়ে অনেক কিছুই লেখাও যাচ্ছে না, বলা যাচ্ছে না ৷ এই হচ্ছে পরিবর্তনের অবস্থা ৷ আমি মনে করি, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আরও বেশি খর্ব হয়েছে ৷ শেখ হাসিনার আমলে এক ধরনের ভীতি ছিল৷ এখন সরকারের কোন ভীতি নেই৷ সরকার কিন্তু বলছে না, এই লেখো, কেন লিখলে? কোন এজেন্সিও মিডিয়ার উপর খবরদারি করছে না৷ কিন্তু মিডিয়া নিজেই
সেন্সরশিপ আরোপ করছে ৷ তার কারণও আছে । এখানে মব ভায়লেন্সের কারণে সংবাদমাধ্যমের উপর এক ধরনের কর্তৃত্ব আরোপ করা হচ্ছে ৷ ভুয়া ছাত্র জনতা সেজে এক প্রকার ত্রাসের রাস রাজাত্ব কায়েম করছে। এরা প্রতিটি সেক্টরে স্বৈরাচারের লুকিয়ে থাকা দোসর । বর্তমানে সাংবাদিক সেজে সাংবাদিকতাকে তলানিতে ঠেকিয়েছে। বর্মমানে যারা সরকারকে প্রশ্ন করছে, সরকারের নানাবিধ কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের কে স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ দিয়ে হুমকি
দিচ্ছে, বিগত সরকারের সাথে ছবি দিয়ে হয়রানী করার চেষ্টা করছে। ফলে
প্রকৃত সাংবাদিকতা হচ্ছে না৷ যেটা হচ্ছে সেটা দৈনন্দিন রিপোর্ট হচ্ছে ৷
বড় ধরনের কোন ইনভেস্টিগেশন (অনুসন্ধান) হচ্ছে না ৷আমি মনে করি আসলে সেই অর্থে গণমাধ্যম স্বাধীন হয়নি ৷ মুখে মুখে স্বাধীন ৷ বাস্তবে কাঠামোটা যদি পরাধীন থাকে বা আগের নিয়মে থাকে তাহলে আমি যে স্বাধীন তার নিশ্চয়তা কোথায়? দেখবেন, মিডিয়া সংকুচিত ৷ বিদ্যমান যে চ্যানেলগুলো আছে, সেখানে সবাই একই মতাদর্শের কথা বলছেন ৷ সেখানে ভিন্নমতের কেউ নেই ৷ মালিকরা তাদের ডাকতে সাহস পাচ্ছে না ৷ এখনও মব সংস্কৃতি বন্ধ করা যায়নি৷ মুখে মুখে স্বাধীনতার কথা শেখ হাসিনাও বলতেন, এখনও তাই দেখছি । কিন্তু বাস্তবে আগের অবস্থা ফিরে আসবে না তার নিশ্চয়তা কি? ফলে কার্যকর ভাবে গণমাধ্যম
স্বাধীন হয়েছে সেটা বলা যাবে না ৷সৈরাচারমুক্ত সুবিধাবাদ বিরোধী
এক্সেপ্রেস নামের একটি ফেক ফেজবুকের বিরুদ্ধে প্রায় শতাধিক পত্র পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলেও সরকার কোন ব্যবস্থা নেই নি।একদিকে একটি গ্রুপ সরকারের সব কার্যকলাপকে ঢালাওভাবে সমর্থন করে, অন্যদিকে বিপরীত মতের আরেকটি গ্রুপ সেই বিরোধিতাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে লিপ্ত। একে
বলা যেতে পারে—সাংবাদিকতা নয়, রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের ছদ্মবেশী প্রচেষ্টা। বর্তমানে সাংবাদিকতায় আস্থা সংকটে জনগণ, নিপীড়নে সত্যনিষ্ঠরা সংবাদ হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের বাস্তবতায় সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন। প্রকৃত ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকদের সামনে এখন
রয়েছে চরম অনিশ্চয়তা ও জীবননাশের ঝুঁকি। যাঁরা সত্য বলার চেষ্টা করছেন,
তাঁরা নানানভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন—কখনও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মামলা,
কখনও গুম, আবার কখনও অনলাইন বা সরাসরি হুমকি। নারী সাংবাদিকরা অনলাইনে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণ, হত্যার হুমকি, কুপ্রস্তাব ও চরিত্র হননের মতো ঘটনা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধাচরণ আজ সুপরিকল্পিতভাবে চালানো হচ্ছে। আমি মনে করি অপসাংবাদিকতার
কলঙ্কিত অধ্যায় আমরা বিরাজ করছি। হলুদ সাংবাদিকতা আজ একটি মহামারিতে রূপ নিয়েছে। অতিরঞ্জিত তথ্য, গুজব ছড়ানো, মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরির মাধ্যমে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করাই এদের লক্ষ্য। প্রকৃত সাংবাদিকদের ও এখন এই ব্ল্যাকমেইল এর শিকার হতে হচ্ছে।
কতিপয় স্বার্থান্বেষী সাংবাদিক বেশী ফেসবুক সাংবাদিক এখন সংবাদ নয়,
বানানো গল্পের মাধ্যমে নিজের অবস্থান পোক্ত করছেন। প্রকৃত সাংবাদিকরা
এদের ছায়াতলে পড়ে চরম হতাশায় ভুগছেন। স্মরণ করা প্রয়োজন, ১/১১ পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একটি অংশের অপসাংবাদিকতা জাতিকে
বিভ্রান্ত করেছিল। তার মাশুল এখনো দিচ্ছে বাংলাদেশ। অতএব, এখনই সময়
অপসাংবাদিকতা ও ভুয়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন। অভ্যুত্থানের পর গণমাধ্যমের নতুন দায়িত্ব নতুন ভাবে পেয়েছে। কিন্ত তার বাস্তবতা কতটুকু। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণমাধ্যমের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। এখন জনগণের আশা—সাংবাদিকরা
নিরপেক্ষ থাকবেন, সত্য বলবেন, এবং দলীয় মোহ ত্যাগ করে জনস্বার্থে কাজ
করবেন। অনেক আইন বাতিলের ঘোষণা এবং স্বাধীন মিডিয়া কমিশন গঠনের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ ইতিবাচক দিক। কিন্তু এই আইন বা কমিশন যতক্ষণ না অপসাংবাদিকতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত পেশাটিকে
সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের জন্য প্রয়োজন
একটি একক, স্বচ্ছ এবং দলনিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম, যা দলীয় বিভাজন,
ব্যক্তিস্বার্থ ও চাটুকারিতা থেকে মুক্ত থাকবে। এ প্ল্যাটফর্ম সাংবাদিকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনবে, সমাজে পেশাটির মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। কিন্ত সেটা এখন লক্ষ করা যাচ্ছে না। এছাড়া গত মার্চে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তাদের সংস্কার বিষয়ক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৷ প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর কমিশনেরপ্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘‘কীভাবে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেটাও আমরা দেখিয়ে দিয়েছি ৷ এখন সরকারের দায়িত্ব এটা বাস্তবায়ন করার । গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যেগুলো এখনই করা সম্ভব, তা সরকার দ্রুত করে ফেলবে। কই কোন কিছুই তো বাস্তব রুপ পাইনি। আমি মনে করি সংবাদমাধ্যমের এখন দু’টি
পক্ষ কাজ করে ‘একপক্ষ খানিকটা নিরপেক্ষভাবেই কাজ করার চেষ্টা করছে, সরকারের তরফ থেকে কোন বাধা নেই ৷ আরেকটা পক্ষ হলো, ওই সংবাদমাধ্যম যে গ্রুপের তাদের স্বার্থ নিয়ে কর্মচারী সাংবাদিকরা সাংবাদিকতা করছে ৷ একেবারে সাংবাদিকতার সুস্থ যে পরিবেশ সেটা বলা যাবে না ৷ আমরা সকলে জানি
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা—যেখানে কলম চলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিপরীতে এবং নিপীড়িতদের পক্ষে। বর্তমানে এই পেশার স্বাধীনতা ও মর্যাদা দুটিই বিপন্ন। তথাকথিত কিছু সুবিধাবাদী নামধারী সাংবাদিক, দলদাস নেতৃত্ব এবং ভুয়া রিপোর্টের বিস্তার আজ জাতির বিভাজন বাড়াচ্ছে। সাংবাদিকরা যদি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে একত্রিত হন, তবে এ পেশা শুধু ঘুরে দাঁড়াবে না, দেশ
ও জাতির পথ প্রদর্শক হয়ে উঠবে। সময় এসেছে আত্মশুদ্ধির, সময় এসেছে সত্য
সংবাদকে ফিরিয়ে আনার। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। এই প্রত্যাশাই আমাদের শক্তি।
গবেষক ও লেখক :
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি, ঢাকা প্রেস ক্লাব
Leave a Reply