মোঃ আশরাফ ইকবাল পিকলু মাজমাদার
খুলনা বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান।
এই দিনটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বিশেষ নেয়ামত।এই দিনের আমল ও ইবাদতের সওয়াব অনেক বেশি।
জুম্মার দিন নিয়ে পবিত্র কোরআনুল কারীমে একটি স্বতন্ত্র সূরাই নাযিল হয়েছে, যার নাম সূরা আল-জুমু’আ (৬২তম সূরা)। এই সূরার ৯ ও ১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা জুম্মার দিনের গুরুত্ব ও করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন
কোরআনে জুম্মার দিনের গুরুত্ব:
১. জুম্মার নামাজের জন্য দ্রুত ধাবিত হওয়ার নির্দেশ (আয়াত ৯)
আল্লাহ তাআলা সূরা আল-জুমু’আর ৯ নম্বর আয়াতে ঈমানদারদের বিশেষভাবে সম্বোধন করে বলেন:
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَوٰةِ مِن يَوْمِ ٱلْجُمُعَةِ فَٱسْعَوْاْ إِلَىٰ ذِكْرِ ٱللَّهِ وَذَرُواْ ٱلْبَيْعَ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
বাংলা অনুবাদ:”হে মুমিনগণ! যখন জুমু’আর দিনে সালাতের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে দ্রুত ধাবিত হও এবং বেচা-কেনা বর্জন কর। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা জানতে।” (সূরা আল-জুমু’আ, ৬২:৯)
এই আয়াত থেকে জুম্মার দিনের নিম্নলিখিত আমল ও নির্দেশনাসমূহ স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়:
জুম্মার আহ্বান: যখন জুম্মার নামাজের জন্য আযান দেওয়া হয়।
আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হওয়া فَٱسْعَوْاْإِلَىٰذِكْرِٱللَّهِ
: এখানে “আল্লাহর স্মরণ” দ্বারা মূলত জুম্মার খুতবা এবং নামাজ উভয়কেই বোঝানো হয়েছে। ‘ফাসআউ’ (ধাবিত হও) শব্দের অর্থ দৌড়ে আসা নয়, বরং গুরুত্বের সাথে ও মনোযোগ দিয়ে দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে যাওয়া।
বেচা-কেনা বর্জন: নামাজের আহ্বানের পর সকল দুনিয়াবী ব্যস্ততা ও বেচা-কেনা বন্ধ করার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হলো, আল্লাহর ইবাদতকে পার্থিব সকল কাজের উপর প্রাধান্য দেওয়া।
২. নামাজ শেষে জীবিকা সন্ধানের অনুমতি (আয়াত ১০)
প্রথম আয়াতে নামাজে দ্রুত যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর, পরের আয়াতে আল্লাহ তাআলা আবার জীবিকা অন্বেষণের অনুমতি দেন: فَإِذَا قُضِيَتِ ٱلصَّلَوٰةُ فَٱنتَشِرُواْ فِي ٱلْأَرْضِ وَٱبْتَغُواْ مِن فَضْلِ ٱللَّهِ وَٱذْكُرُواْ ٱللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
বাংলা অনুবাদ:”অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হয়, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো ও আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (সূরা আল-জুমু’আ, ৬২:১০)
এই আয়াত থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা:
সালাত সমাপ্তির পর: জুম্মার নামাজ ও খুতবা শেষ হওয়ার পর।
পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া: নামাজ শেষ হলে পুনরায় যার যার জীবিকা ও হালাল রিজিক অনুসন্ধানে ফিরে যাওয়া। এটি এই বার্তা দেয় যে ইসলামে কর্মবিমুখতা কাম্য নয়, বরং ইবাদত ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
আল্লাহকে অধিক স্মরণ: সব সময়, এমনকি কর্মব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ وَٱذْكُرُواْٱللَّهَكَثِيرًاকরার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এটিই সফলতার মাপকাঠি।
নিচে জুম্মার দিনের কিছু বিশেষ আমল ও তার বিস্তারিত দেওয়া হলো:
১. উত্তমরূপে গোসল করা
জুম্মার দিন গোসল করা একটি ওয়াজিব (আবশ্যকের মতো) বা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জুম্মার দিনে প্রত্যেক সাবালকের জন্য গোসল করা ওয়াজিব।” (সহীহ বুখারী)। পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার জন্য উত্তমরূপে গোসল করা উচিত।
২. উত্তম পোশাক পরিধান ও সুগন্ধি ব্যবহার
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সম্ভব হলে উত্তম পোশাক পরিধান করা এবং সুগন্ধি ব্যবহার করা (পুরুষদের জন্য) সুন্নাত। এর মাধ্যমে জুম্মার নামাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা হয়।
৩. আগে আগে মসজিদে যাওয়া
জুম্মার নামাজের জন্য আগে আগে মসজিদে যাওয়া অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি সবার আগে মসজিদে যায়, সে যেন একটি উট কুরবানি করার সওয়াব পায়। এরপর যে আসে সে গাভী, তারপর ভেড়া, তারপর মুরগি, এরপর ডিম দান করার সওয়াব পায়। ইমাম খুতবার জন্য মিম্বরে বসার পর ফেরেশতারা সওয়াব লেখা বন্ধ করে দেন।
৪. সূরা কাহফ তিলাওয়াত করা
জুম্মার দিন সূরা কাহফ তিলাওয়াত করা খুবই ফজিলতপূর্ণ আমল। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুম্মার দিন সূরা কাহফ তিলাওয়াত করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে দুই জুম্মার মধ্যবর্তী সময় বিশেষ নূর দ্বারা আলোকিত করে রাখবেন।”
৫. বেশি বেশি দরুদ শরীফ পাঠ করা
জুম্মার দিন ও রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উপর বেশি বেশি দরুদ শরীফ পাঠ করা। তিনি (সা.) বলেছেন, “তোমরা জুমার দিনে আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো, কারণ তোমাদের পাঠকৃত দরুদ আমার সামনে পেশ করা হয়।”
৬. জুম্মার নামাজ মনোযোগ সহকারে আদায় করা
জুম্মার দিন এটিই প্রধান ইবাদত। খুতবা শুরু হওয়ার পর থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে খুতবা শোনা এবং চুপ করে থাকা উচিত। খুতবার সময় কথা বলা বা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকা উচিত নয়।
৭. দোয়া কবুলের বিশেষ মুহূর্ত
জুম্মার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার একটি বিশেষ সময় রয়েছে। এই সময় আল্লাহর কাছে কোনো কল্যাণ কামনা করে দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন। হাদিস অনুযায়ী, এই বিশেষ মুহূর্তটি সাধারণত আসর নামাজের পর থেকে মাগরিবের আগ পর্যন্ত বা ইমাম খুতবার জন্য মিম্বরে বসার সময় থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত হতে পারে। এই সময়টিতে বেশি বেশি দোয়া ও মোনাজাত করা উচিত।
৮. অন্যান্য সৎ কাজ
দান-সদকা করা।
নখ কাটা ও শরীরের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা।
সম্ভব হলে পিতা-মাতার কবর যিয়ারত করা (যদি তারা ইন্তেকাল করে থাকেন)।
জুম্মার দিনের অতিরিক্ত আমল ও সুন্নাতসমূহ:
১. জুম্মার রাতের আমল
জুম্মার দিনের ফজিলত তার রাত থেকেই শুরু হয়।
বেশি পরিমাণে দরুদ শরীফ পাঠ: জুম্মার রাত (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) থেকেই রাসূল (সা.)-এর উপর বেশি বেশি দরুদ পাঠের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সূরা দুখান তিলাওয়াত: হাদিসে জুম্মার রাতে সূরা দুখান তিলাওয়াতের বিশেষ ফজিলতের কথা উল্লেখ আছে।
২. সকালের আমল
ফজরের নামাজ জামাতে আদায়: জুম্মার দিন ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করা এবং প্রথম রাকাতে সূরা সিজদা ও দ্বিতীয় রাকাতে সূরা দাহর (বা ইনসান) তিলাওয়াত করা সুন্নাত।
৩. জুম্মার নামাজের জন্য প্রস্তুতিমূলক আমল
জুম্মার নামাজের আগে বেশ কিছু শারীরিক ও আত্মিক প্রস্তুতি নেওয়া সুন্নাত ও সওয়াবের কাজ:
মি-সওয়াক ব্যবহার: গোসলের আগে বা নামাজের আগে মি-সওয়াক বা দাঁত পরিষ্কার করা। রাসূল (সা.) জুম্মার দিন মি-সওয়াক করতে উৎসাহিত করেছেন।
জুম্মার দিনের গোসলকে শুধুমাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হিসেবে না দেখে, ইবাদতের অংশ হিসেবে দেখা উচিত।
গোসলের নিয়ম: জুম্মার নামাজের জন্য উত্তমভাবে গোসল করা। ইমাম নববী (রহ.) এর মতে, গোসলের সময় ফজর উদয় হওয়ার পর থেকে জুম্মার নামাজের জন্য বের হওয়ার আগ পর্যন্ত।
পরিচ্ছন্নতা: গায়ের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা এবং প্রয়োজনে নখ কাটা। হাদিসে এই কাজগুলো জুম্মার দিনের সুন্নাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উত্তম পোশাক: নিজের কাছে থাকা সবচেয়ে পরিষ্কার ও উত্তম পোশাক পরিধান করা।
পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া: যদি সম্ভব হয়, তাহলে যানবাহনে না গিয়ে পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া। প্রতি কদমে নেকী লাভ হয়।
৪. মসজিদে প্রবেশের পর করণীয়
আগে প্রবেশ করা: যত দ্রুত সম্ভব মসজিদে প্রবেশ করা।
সালাম ও তাহিয়্যাতুল মসজিদ: মসজিদে প্রবেশ করে কাউকে কষ্ট না দিয়ে যেখানে খালি জায়গা পাওয়া যায়, সেখানেই বসা। এরপর দু’রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ (মসজিদে প্রবেশের সুন্নাত নামাজ) আদায় করা। ইমাম খুতবা দেওয়া শুরু করলেও এই নামাজ সংক্ষেপে পড়ে নেওয়া যায়।
ইমামের কাছাকাছি বসা: সম্ভব হলে ইমামের কাছাকাছি বসার চেষ্টা করা।
নফল নামাজ আদায়: জুম্মার আজান হওয়ার আগ পর্যন্ত যত খুশি নফল নামাজ আদায় করা।
৫. জুম্মার নামাজের সময়
খুতবা শোনা: ইমাম খুতবা শুরু করলে সম্পূর্ণ চুপ থেকে মনোযোগ সহকারে খুতবা শোনা ওয়াজিব। এই সময় কথা বলা, মোবাইল ব্যবহার করা বা অন্য কোনো কাজ করা কঠোরভাবে নিষেধ। এতে জুম্মার নামাজের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়।
আঙুল নিয়ে খেলা না করা: খুতবার সময় নিজের জামা, টুপি বা আঙুল নিয়ে খেলা করা থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
৬. দোয়া কবুলের বিশেষ সময়
জুম্মার দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলোর মধ্যে একটি হলো দোয়া। রাসূল (সা.) বলেছেন, জুম্মার দিন একটি বিশেষ মুহূর্ত আছে, যখন কোনো মুসলিম বান্দা আল্লাহর কাছে কোনো ভালো কিছুর দোয়া করলে আল্লাহ তা অবশ্যই কবুল করেন।
দোয়া করার সবচেয়ে শক্তিশালী সময়: অধিকাংশ আলেম ও হাদিস বিশেষজ্ঞের মতে, এই বিশেষ মুহূর্তটি হলো আসর নামাজের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত (মাগরিবের আজানের আগ পর্যন্ত)। এই সময়টায় ইবাদত ও দোয়ায় মগ্ন থাকা উচিত।
৭. ফজিলতপূর্ণ ঘটনা
জুম্মার দিনের ফজিলতের পেছনে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে, যা এর গুরুত্বকে আরও বাড়িয়েছে:
এই দিনে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল।
এই দিনেই তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেছিলেন এবং এই দিনেই তাঁকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কেয়ামত বা মহাপ্রলয় এই দিনেই সংঘটিত হবে।
যাদের মৃত্যু জুম্মার দিন বা রাতে হয়,আল্লাহ তাদেরকে কবরের আজাব থেকে মুক্তি দেন।
জুম্মার দিনের আমলগুলো পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য, তবে সালাতের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেহেতু নারীদের ওপর মসজিদে গিয়ে জুম্মার জামাতে অংশগ্রহণ করা ফরয নয়,তাই তাদের জুম্মার দিনে জুম্মার সালাতের ব্যতিক্রম ছাড়া অন্যান্য সকল সুন্নাত ও নফল আমল ঘরে বসেই পালন করতে পারেন এবং পূর্ণ সওয়াবের অংশীদার হতে পারেন।
আল্লাহ্ তুমি সবাইকে সঠিক বুঝ দাও আমিন।
Leave a Reply