(মোঃ রাজিব হাসান রাজু চরফ্যাশন উপজেলা প্রতিনিধি)
মসজিদের পবিত্র আঙিনায় যখন একটি শিশুর ধর্ষিত লাশ পড়ে থাকে, তখন বুঝতে হবে কেবল একজন খুন হয়নি, খুন হয়েছে আমাদের নিরাপত্তা, আস্থা এবং বর্তমান সমাজের শাসন ব্যবস্থা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে ৯ বছরের শিশু ময়না আক্তারের রক্তাক্ত, বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, এটি আমাদের ক্ষয়িষ্ণু সমাজ এবং উদাসীন রাষ্ট্রব্যবস্থার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি।
শনিবার দুপুরে যে শিশুটি খেলার জন্য ঘর থেকে বেরিয়েছিল, পরদিন সকালে তার নিথর দেহ পাওয়া গেল গ্রামের মসজিদের দোতলায়। গলায় কাপড় প্যাঁচানো, শরীরে পাশবিক নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্ন, এই দৃশ্য এক মুহূর্তের জন্য কল্পনা করলেও সভ্য সমাজের যেকোনো মানুষের শরীর শিউরে ওঠে। ময়নার প্রবাসী বাবা হয়তো দূর দেশে হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে মেয়ের হাসিমুখটা কল্পনা করতেন। আজ তার কাছে কোন খবর পৌঁছাবে? কোন ভাষায় তাকে বোঝানো হবে যে, তার ছোট্ট মেয়েটি নিজের দেশেই, নিজের গ্রামের সবচেয়ে নিরাপদ বলে পরিচিত একটি স্থানেই নিরাপদ ছিল না?
এই ঘটনাটিকে শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এটি বহুস্তরীয় ব্যর্থতার চূড়ান্ত পরিণতি, যা আমাদের সামনে কয়েকটি কঠিন সত্যকে তুলে ধরে।
১. সামাজিক অবক্ষয়ের গভীরতা
প্রথমত, এই ঘটনা আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের গভীরতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। যে সমাজে মসজিদের মতো পবিত্র স্থানও শিশুর জন্য অনিরাপদ হয়ে ওঠে, সেখানে আর কোন আশ্রয়ের ভরসা থাকবে? অপরাধীর মনে আইন বা শাস্তির ন্যূনতম ভয় কাজ করলে, কিংবা সমাজের প্রতি সামান্য দায়বদ্ধতা থাকলে এমন পৈশাচিক কাজ করা সম্ভব নয়। এটি প্রমাণ করে, অপরাধীরা এখন এতটাই বেপরোয়া যে তাদের বর্বরতার কোনো সীমা নেই। ধর্মীয় বা সামাজিক কোনো অনুশাসনই তাদের কাছে আর বাধা নয়।
২. রাষ্ট্রের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার দায়
দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো রাষ্ট্রের ভূমিকা। প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধানতম দায়িত্ব। কিন্তু একের পর এক নারী ও শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা যখন ঘটতেই থাকে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ময়নার এই হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এর আগেও আমরা দেখেছি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি কীভাবে অপরাধীদের আরও হিংস্র করে তোলে। প্রতিটি ঘটনার পর কিছু রুটিন পদক্ষেপ নেওয়া হয়—মরদেহ উদ্ধার, ময়নাতদন্ত, সন্দেহভাজন দু-একজনকে আটক এবং তারপর শুরু হয় দীর্ঘ এক বিচারিক প্রক্রিয়া, যা অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
এই ধারাবাহিক নিষ্ক্রিয়তা এবং বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতা অপরাধীদের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেয়—অপরাধ করলেও পার পাওয়া সম্ভব। ময়নার হত্যাকারী বা হত্যাকারীরাও হয়তো সেই বার্তা থেকেই এমন নৃশংসতার সাহস পেয়েছে। যখন রাষ্ট্র তার নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই ব্যর্থতার দায়ভার শাসকের কাঁধেই বর্তায়।
৩. প্রশাসনের দায়বদ্ধতা ও নাগরিকের প্রত্যাশা
পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে যেকোনো সরকার ক্ষমতায় আসুক না কেন, নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে সেই সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সামাজিক অবক্ষয় বা বিচারহীনতার সংস্কৃতি একদিনে তৈরি হয়নি, কিন্তু এর প্রতিকার করার দায়িত্ব বর্তমান প্রশাসনের। শুধুমাত্র শোকবার্তা বা বিচ্ছিন্ন কিছু গ্রেপ্তারি অভিযান এই গভীর ক্ষতের ওপর মলমের প্রলেপ হতে পারে না। মানুষ দেখতে চায় কার্যকর পদক্ষেপ, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং দ্রুততম সময়ে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। বর্তমান প্রশাসন যদি জনগণের আস্থা অর্জন করতে চায়, তবে ময়নার মতো হাজারো নির্যাতিতের বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা কেবল ক্ষমতার পালাবদলের অংশ নয়, বরং প্রকৃত অর্থেই নাগরিকের নিরাপত্তা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ।
ময়নার রক্তাক্ত জামা আজ পুরো জাতির বিবেকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে: আমার কী অপরাধ ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা কেবল শোক, সমবেদনা আর কয়েকটি সংবাদ প্রতিবেদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি, তবে অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক ময়নাকে আমরা হারাবো। এই লজ্জা কেবল ময়নার পরিবারের নয়, এই লজ্জা আমাদের সবার—সমাজের, এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রতিটি ব্যক্তির। এখনই সময়, এই সম্মিলিত লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে কঠোর হাতে অপরাধ দমনের এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার।
Leave a Reply