হাফিজুর রহমান(যশোর)প্রতিনিধি
ধীরাজ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯০৫ সালে যশোর জেলার কেশবপুর থানার পাঁজিয়া গ্রামে। পিতা ললিতমোহন ভট্টাচার্য ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক ছিলেন। পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে তিনি তাঁর অসামান্য শৈল্পিক প্রতিভায় লক্ষ মামুষের হৃদয় রাজ্যে হয়ে উঠেছিলেন এক উজ্জল নক্ষত্র।
নিজ গ্রামের পাঁজিয়া স্কুলে ধীরাজ ভট্টাচার্যের শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। পরে তিনি কোলকাতা মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯২৩ সালে ম্যট্রিকুলেশন পাস করেন। আশুতোষ কলেজে আই. এস. সি তে ভর্তি হন। কলেজে আই. এস. সি পড়াকালীন সিনেমা ও সাহিত্যচর্চার প্রতি আকৃষ্ট হন, ফলে আর আই. এস. সি পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি।
সুদর্শন চেহারা, ঘন কোঁকড়ানো চুল, ইষৎ ট্যারা হলেও চোখের চাউনিতে মাদকতা। চিত্র পরিচালক জ্যোতিষ বন্দোপাধ্যায়ের পছন্দ হয়ে যায় ধীরাজ বাবুকে। তাঁর সহযোগিতায় ১৯২৪ সালে ম্যাডান কোম্পানীর নির্বাক ছবি ‘সতী লক্ষী’তে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান।
সিনেমায় অভিনয় করায় বাড়ীতে অশান্তি; আত্মীয় স্বজনের মধ্যে অসন্তোষ। তাই সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্যে ধীরাজের বাবা ধীরাজকে পুলিশের ভর্তি করে দেন। প্রথম পোস্টিং হয় কোলকাতায়। এরপর চট্টগ্রামের টেকনাফে পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব নিয়োজিত হন তিনি। সেখান থেকে বার্মায়।
টেকনাফের মাথিনের কূপকে কেন্দ্র করে ধীরাজ-মাথিনের প্রেম কাহিনী একটি কালজয়ী উপাখ্যান। তার এ প্রেম ও পুলিশ বিভাগের চাকরির ঘটনাবলি নিয়ে লেখা তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘যখন পুলিশ ছিলাম’, পুলিশের চাকরিতে নানা বিপর্যয়ের কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন ধীরাজ।
কোলকাতায় ফিরে পুনরায় সিনেমা জগতে প্রবেশের চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯৩০ সালে চিত্র পরিচালক মধু বাবুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। মধু বাবু তখন তাঁর ছবির জন্যে নতুন মুখ খুঁজছিলেন। মধু বাবু আবিষ্কার করলেন ধীরাজকে। বিখ্যাত অভিনেতা এবং পরিচালক নরেশ মিত্র ও ধীরাজ বাবু দু’জনই যশোর জেলার মানুষ। নরেশ বাবু ধীরাজকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি অভিনয়ের ব্যাপারে যতটুকু পেরেছেন তালিম দিয়ে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন। যে সমস্ত নির্বাক ছবিতে অভিনয় করে ধীরাজ বাবু তাঁর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন, সেগুলি ‘সতীলক্ষ্ণী’, ‘গিরিবালা’, ‘বাসবদত্ত’, ‘কালপরিণয়’, ‘মৃণালিনী’, এবং রবীন্দ্রনাথের কাহিনী অবলম্বনে ‘নৌকাডুবি’। শেষোক্ত ছবিটির পরিচালক নরেশ মিত্র।
সবাক যুগে ধীরাজ বাবুর প্রথম ছবি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’। এরপর থেকেই ধীরাজবাবু একের পর এক অভিনয় করে চললেন। পৌরাণিক ও ধর্মমূলক ছবিতে। ‘যমুনা পুলিন’, ‘চাঁদ সদাগার’, ‘দক্ষযক্ষ’, ‘রাজ নটি’, ‘বসনত্মসেনা’, ‘বাসব দত্তা’, ‘নরনারায়ণ’, ‘কৃষ্ণসুদামা’ ইত্যাদি।
১৯৩৫ সালে ধীরাজ বাবু ‘কণ্ঠহার’, ছবিতে কাননদেবীর বিপরীতে ভিন্নধর্মী, কিছুটা ভিলেন টাইপের রোল। ‘জোয়ার ভাটা’ নামে চার রিলের একটা ছোট ছবিও পরিচালনা করেছিলেন। কোলকাতায় বসবাস করলে ও জন্মভূমি পঁজিয়া ছিল তার চারণক্ষেএ । সময় সুযোগ পেলেই তিনি পাঁজিয়া আসতেন।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তাঁর সাহিত্য সাধনা অব্যাহত ছিল। দেশ পত্রিকার পাতায় ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ ও ‘যখন নায়ক ছিলাম’ – আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হবার পর পাঠক সমাজে বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর লিখিত অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘মন নিয়ে খেলা’, ‘সাজানো বাগান’ ও ‘মহুয়া মিলন’ উল্লেখযোগ্য।
১৯৩৪ সালে ধীরাজ বাবু বিয়ে করেন চব্বিশ পরগণার গোপালপুর নিবাসী বিনোদ চৌধুরীর কন্যা শ্রীমতি সরস্বতী চৌধুরীকে। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।
১৯৫৯ সালের ৪মার্চ চলচ্চিত্র শিল্পের নায়ক ও সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্রাচার্যের মৃত্যু হয়।
Leave a Reply